আপনার শখের ক্যামেরার যত্ন নিন
যত্ন করলে রত্ন মেলে—এমন প্রবাদ প্রচলিত আছে। ডিজিটাল ক্যামেরার যত্ন ও ব্যবহারে আলোকচিত্রীর রুচিশীলতাই প্রকাশ পায়। আর এখন তো অনেকের হাতেই ডিজিটাল ক্যামেরা৷ তা অটোফোকাস হোক আর এসএলআরই হোক৷ যত্নটা বেশি লাগে ডিজিটাল এসএলআর (সিঙ্গেল লেন্স রিফ্লেক্ট) ক্যামেরার৷ পেশাদার আলোকচিত্রীরা একাধিক ক্যামেরা, লেন্স, ব্যাগ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন। ফলে তাঁদের বিশেষ যত্ন নিতে হয়। যাঁরা শখের বসে ছবি তোলেন, তাঁদেরও যত্নের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।
বড় শত্রু পানি-
ডিজিটাল ক্যামেরার সবচেয়ে বড় শত্রু পানি। বৃষ্টিতে ভিজে বা পানিতে ডুবে ক্যামেরা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ক্যামেরার ভেতরে পানি ঢুকলে এর মাদারবোর্ডে মরিচা পড়ে। পানি ঢোকামাত্র শুকনো কাপড় বা টিস্যু পেপার দিয়ে মোছা উচিত। আইক্যাপ আর ফিতা লাগানোর জায়গা দিয়ে সাধারণত ক্যামেরার ভেতর পানি ঢোকে৷ এই অবস্থায় ক্যামেরার সুইচ অন থাকলে শর্টসার্কিট হতে পারে। তাই সুইপ অফ করে ক্যামেরা হালকা রোদে শুকাতে হবে৷ ক্যামেরা যেহেতু ব্যাটারিচালিত যন্ত্র, তাই পানি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটারি খুলে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ। সমুদ্রের কাছে ছবি তুলতে গেলে খুবই সাবধানে ক্যামেরা ব্যবহার করতে হবে। লোনা পানি দ্রুতই ক্যামেরার যন্ত্রাংশের ক্ষতি করে৷ তখন মেরামত করেও কাজ হয় না৷
বর্ষা মৈাসুমে সাবধান-
বর্ষা মৌসুমে বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকে৷ স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের কারণে ক্যামেরা ও লেন্সের ভেতর ছত্রাক বা ফাঙ্গস পড়তে পারে৷ ফাঙ্গাস বেশি পড়লে ছবিতে আলো-ছায়ার বৈপরিত্য বা কন্ট্রাস্ট থাকে না। ছবির তীক্ষ্ণভাব কমে যায়। সঠিক রং পাওয়া যায় না। লেন্সে ছত্রাক পড়ে গেলে তা পরিষ্কার করাতে হবে ভালো কোনো সার্ভিস সেন্টারে৷ ঘষা লেগে অনেক সময় লেন্সের ভেতরে স্থায়ী দাগ (স্ক্র্যাচ) পড়তে পারে। আবার আর্দ্রতার কারণে লেন্সের বিভিন্ন ধাতব অংশেও মরিচা পড়ে। এই মরিচা একে অন্যের সঙ্গে ভাববিনিময় করে। এর ফলে ইলেকট্রিক সার্কিটগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
ধুলাবালু থেকে ক্যামেরা বাচিঁয়ে রাখুন-
ধুলাবালু ক্যামেরার অন্যতম শত্রু। খোলা জায়গা বা ধুলা ওড়ে এমন জায়গায় লেন্স পরিবর্তন করা ঠিক নয়। লেন্স খোলার কারণে প্রথমে আয়না বা মিরর অংশে ময়লা ঢোকে৷ তারপর শাটার চাপলে সেন্সরে গিয়ে ময়লা জমা হয়। ফলে ছবিতে কালো কালো দাগ পড়ে যেতে পারে। অন্তত চার মাস পর পর সেন্সর পরিষ্কার করা উচিত। লেন্সের সামনে সার্বক্ষণিক ইউভি (অতি বেগুনি রশ্মি) বা এসএল (স্কাইলাইট) ফিল্টার লাগিয়ে রাখা ভালো। ফিল্টার মূলত আলোর ছাঁকনির কাজ করে। ফিল্টার লাগানো থাকলে লেন্সে ধুলাবালু ঢুকতে পারে না। কাজ শেষে লেন্স ক্যাপ লাগানো, আইক্যাপ বন্ধ রাখা এবং লেন্স হুড ব্যবহার কাজেরই অংশ।
তাপমাত্রা থাক স্বাভাবিক-
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি রাখা উচিত। অতিরিক্ত ঠান্ডা জায়গায় বেশিক্ষণ ক্যামেরা রাখা ঠিক নয়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে ক্যামেরা রাখলে লেন্সে জলীয়বাষ্প জমে। ফলে ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে কিছু দেখা যায় না, ঝাপসা লাগে। সহজে ফোকাস হতে চায় না। জলীয়বাষ্প না শুকানো পর্যন্ত ছবি তোলা কঠিন। মানুষের সহ্য করার মতো গরম আবহাওয়া ক্যামেরার জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। তাই বলে অতিরিক্ত তাপমাত্রায়ও ক্যামেরা রাখা ঠিক নয়। বৈদ্যুতিক তার, ট্রান্সমিটার ও অগ্নিকাণ্ডের ছবি তোলার সময় নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে তোলা উচিত। আগুনের অতিরিক্ত তাপে লেন্সের প্রলেপ (কোটিং) ফেটে চৌচির হয়ে যেতে পারে। ফলে অপ্রয়োজনে আগুনের কাছে ক্যামেরা বাড়িয়ে ধরা বোকামি। অনেক সময় এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও বটে৷
নিয়মিত ব্যাটারির চার্জ করুন-
নিয়মিত ব্যাটারি চার্জ করুন। চার্জ সম্পূর্ণ হলে খুলে ফেলুন। বেশি চার্জ অনেক সময় ব্যাটারিকে দুর্বল করে দেয়। ছয় মাস পর পর ব্যাটারি পরীক্ষা করা (ক্যালিব্রেট) উচিত। মেমোরি কার্ড খোলা, লেন্স পরিবর্তন বা ব্যাটারি পাল্টানোর ক্যামেরার সুইচ বন্ধ রাখতেই হবে৷ ব্যবহারের পর ফ্ল্যাশগানের সুইচও বন্ধ রাখা উচিত। ক্যামেরার মনিটরে স্বচ্ছ পর্দা লাগিয়ে রাখা ভালো। ভুলবশত এসএলআর ক্যামেরার সুইচ অফ না করাটা তেমন সমস্যা নয়। কিছু সময় পর পাওয়ার স্ট্যান্ডবাই হয়ে যায়। তবে কমপ্যাক্ট ক্যামেরার পাওয়ার অন থাকলে লেন্স বেরিয়ে এসে ক্যামেরায় বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। তাই কাজ শেষে কমপ্যাক্ট ক্যামেরার ব্যাটারি খুলে রাখা ভালো। উচ্চগতির কার্ড রিডার ও মেমোরি কার্ড ব্যবহারে কাজ হয় দ্রুত। মেমোরি কার্ড থেকে ছবি কম্পিউটারে নামানোর সময় অ্যান্টি ভাইরাস সফটওয়্যার দিয়ে কার্ড স্ক্যান করা উচিত।
ইচ্ছেমতো ভিডিও নয়-
বেশির ভাগ ডিজিটাল ক্যামেরায় ভিডিও করার সুবিধা এখন আছে। তবে অপ্রয়োজনে ভিডিও করা ঠিক নয়। ভিডিও করলে ক্যামেরার শরীরে বাড়তি চাপ পড়ে। একটি পেশাদার ডিএসএলআর ক্যামেরায় টানা ১২ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত ভিডিও করা যায়। তারপর এটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রয়োজন হলে কিছু সময় বিশ্রাম দিয়ে আবার ভিডিও করা যেতে পারে। ক্যামেরা ব্যবহার করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ‘এরর’ দেখায়। এরর হচ্ছে ক্যামেরা বা লেন্সের অপারগতা প্রকাশ। এরর দেখায় মূলত ক্যামেরার সঙ্গে লেন্সের সংযোগ ঠিকমতো না ঘটলে৷ এ ছাড়া জুম করার সময় কখনো কখনো অ্যাপারচার নড়তে পারে না। তখনো এরর দেখাতে পারে। শাটারের সমস্যার কারণেও এরর দেখায়।
শাটার টিপুন হিসেব করে-
শাটার কাউন্টের মাধ্যমে ডিএসএলআর ক্যামেরার জীবনকাল নির্ধারণ করা হয়। ধরুন, ক্যানন ১১০০ডি ক্যামেরায় দেড় লাখ পর্যন্ত ছবি তোলা যায়। অনেক সময় এই হিসাবের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ছবিও তোলা যেতে পারে। এরপর শাটার নষ্ট হয়ে যায়। এটা পরিবর্তন করলে আবার ঠিক আগের মতো কাজ করে। ফলে অহেতুক কন্টিনিউ মোডে শাটার টেপা ঠিক না। শাটার হচ্ছে পর্দার মতো। এটি মোটরে চলে। তবে পেশাদার ক্যামেরার শাটার অনেক মজবুত।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা-
প্রতিদিন ব্যবহারের পর ক্যামেরা পরিষ্কার করে রাখা উচিত। কাজ শেষে না পারলে অন্তত পরের দিন বা ছবি তুলতে যাওয়ার আগে পরিষ্কার করা দরকার। মোছামুছির ব্যাপারটা প্রতিদিনকার রুটিনে পরিণত করতে পারলে ভালো। ক্যামেরার ব্যাগে সব সময় নরম কাপড়, ব্রাশ, ব্লোয়ার, টিস্যু পেপার রাখা যেতে পারে। ব্যাগের কোথাও একটু সিলিকা জেল রাখুন। লেন্স পরিষ্কারের জন্য লেন্স ক্লিনার ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্যামেরার ব্যাগে এমনভাবে ক্যামেরা, লেন্স ও ফ্ল্যাশগান রাখা উচিত, যেন একটির সঙ্গে আরেকটির অতিরিক্ত চাপ না লাগে। যেমন-তেমন ব্যাগে ক্যামেরা বহন করা উচিত নয়। বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগেই রাখতে হবে ক্যামেরা, লেন্স ইত্যাদি৷
আঘাত নয়-
কোনো অবস্থাতেই ক্যামেরার গায়ে আঘাত লাগানো যাবে না। বাইরে থেকে আঘাত পেলে ভেতরের সূক্ষ্ম জোড়াগুলো নড়ে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। বাতাস ঢুকতে পারে না এমন বাক্স কিংবা ডেসিকেটরে ক্যামেরা রাখুন। বাক্সে সিলিকা জেল ব্যবহার করুন। এই জেল ছত্রাক থেকে ক্যামেরা ও লেন্সকে রক্ষা করে। সিলিকা জেল যখন জলীয়বাষ্প শোষণের ক্ষমতা হারায়, তখন এর রং বদলায়। একটি ক্যামেরা ও দুটি লেন্স রাখার জন্য কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার ডেসিকেটর প্রয়োজন। ডেসিকেটরে ক্যামেরা রাখা নিরাপদ। তবু মাঝে মাঝে বের করে ছবি তোলা দরকার। এতে ক্যামেরা সচল কি না, নিশ্চিত থাকা যায়।
আরও কিছু কথা -
- ছবি তোলার সময় হাতে ক্যামেরার বেল্ট পেঁচিয়ে নিন বা গলায় ঝুলিয়ে রাখুন। এতে ক্যামেরা মাটিতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কোথাও ক্যামেরা রাখলে ধীরে-সুস্থে রাখুন, যেন চোট না লাগে।
- লেন্স লাগানোর সময় জোরাজোরি করবেন না।
- কাঁধে থাকার কারণে অনেক সময় বেল্টে ময়লা জমে। তাই লেন্সের সঙ্গে বেল্ট পেঁচিয়ে রাখবেন না।
- শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন।
- কাজ শেষে ক্যামেরা ব্যাগে ভরে রাখুন।
- যেহেতু এটি একটি দামি যন্ত্র, তাই সাবধানে বহন করা উচিত। ক্যামেরা ও লেন্সের সিরিয়াল নম্বর এবং মূল কাগজপত্র যত্নসহ সংরক্ষণ করতে হবে। এতে খোয়া গেলে আইনি সহায়তা পেতে সুবিধা হয়।
- পেশাদার আলোকচিত্রীদের উচিত ক্যামেরার বিমা করা।
লেখক: সাহাদাত পারভেজ
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো
ছবিঃ দৈনিক প্রথম আলো ও সংগৃহীত
মন্তব্য (0)
ফেসবুক মন্তব্য (0)