মেঘনার বুকে চলতে চলতে শিল্পীদের ৭০টি চিত্রকর্ম

মেঘনার বুকে চলতে চলতে শিল্পীদের ৭০টি চিত্রকর্ম

মেঘনার বুকে উথাল পাথাল ঢেউ। মাথার উপর খোলা আকাশ। গনগনে সূর্য। রৌদ্রোজ্জ্বল উষ্ণতা ও প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে শীতল বাতাস। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে এমভি মধুমতি।

 

নদীর দুই ধারে সবুজ প্রকৃতি; ছোট ছোট জেলে নৌকায় ধরা পড়ছে রুপালি ইলিশ। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে থাইল্যান্ডের তরুণী শিল্পী পুন্নিসা অভিভূত।

হাত দুটো খোলা হাওয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে তার বিস্ময়ের জানান দিলেন। সাতাশ বছর বয়সী এই শিল্পী একটু পরে তার ক্যানভাসে রংতুলির আঁচড় দিলেন। ঘণ্টা দুয়েক পর এসে দেখা গেল তিনি বিশাল প্রশস্ত এক নদী এঁকেছেন। নদীতে ছোট ছোট অনেক নৌকা আর দুই ধারে অবারিত সবুজ। পুন্নিসা জানালেন, থাইল্যান্ডেও নদী আছে তবে এত বিশাল আর প্রশস্ত নদী তিনি দেখেননি। এমনিভাবেই নৌবিহারে এসে বিশ্বের নানা প্রান্তের শিল্পীরা তাদের ক্যানভাসে বাংলাদেশকে এবং তাদের ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করেছেন।

 

১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর চতুর্থ দিনে শিল্পীদের নিয়ে এ নৌবিহারের আয়োজন করা হয়। যাতে ছিল আর্ট ক্যাম্প ও বিভিন্ন দেশের গান নিয়ে সাংস্কৃতিক আয়োজন।

 

শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় বিয়েনালে অংশ নেয়া প্রায় ৭০ শিল্পীকে নিয়ে সদরঘাট থেকে এমভি মধুমতি লঞ্চ চাঁদপুরের উদ্দেশে যাত্রা করে। এতে জাপানি চিত্রকর তেতসুইয়া নোদা, বিশ্ব চিত্রসমালোচক সংস্থার সভাপতি মারেক বার্টিলেক, ভারতের বরেণ্য চিত্রকর যোগেন চৌধুরী, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীসহ একটি দেশের একটি সাংস্কৃতিক দলও অংশগ্রহণ করে।

 

রংতুলি আর ক্যানভাস নিয়ে জাহাজের তৃতীয়তলার বিশাল খোলা জায়গায় শিল্পীরা তাদের চিত্রকর্ম সৃজনের কাজ শুরু করেন ১০টার দিকে। চীনের শিল্পী লি লে ক্যানভাস রাঙিয়েছেন নীল রঙে। ফ্রান্সের শিল্পী চালি নিজকুলা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি তার চিত্রকর্মে লাল আর হলুদের মিশেলে রঙের খেলা ফুটিয়ে তুললেন।

 

জাপানি তরুণী শিল্পী ইউনা কাছে যেতেই দেখা গেল তার এক হাতে একটি হলুদ গোলাপ। কিছুক্ষণ পর একটা ছোট ব্যাগ থেকে বের করলেন জীবন্ত প্রজাপতি। তার ক্যানভাস ফুল আর প্রজাপতি সঙ্গে লাল, নীল, কালো রঙের বাহারে শোভিত হলো।

তাজিকিস্তানের তরুণ শিল্পী আবদুল্লাহ একজন নারীমুখের পাশে হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডে ছোট্ট একটা প্রজাপতি আঁকলেন। বললেন, নারী হলো জীবন, হাসি ও শক্তির প্রতীক। তার সঙ্গে হলুদ রং সূর্যের আভা। কাজিকিস্তানে শিল্পচর্চা এখনও সেভাবে হয় না। তবে পুরুষদের পাশাপাশি অনেক নারী এখন দেয়াল ভাঙার হাতিয়ার হিসেবে চিত্রকলাকে বেছে নিয়েছেন।

 

কলকাতার শান্তিনিকেতনের চারুকলার শিক্ষক অমিয় নিমাই ধর তার ক্যানভাসে বাংলাদেশের পতাকার উপরে নদীতে চলা অনেক নৌকা এঁকেছেন। তিনি বলেন, সুজলা সুফলা বাংলাদেশের প্রাণ তো এই নদী। একটু পরে তিনি বললেন, দুই বাংলা মিলে যদি একটা দেশ হতো তবে কতই না ভালো হতো। সীমানা আমাদের আলাদা করলেও আমাদের মনটা কিন্তু একই।

 

এরই মধ্যে দেখা গেল দেশের খ্যাতনামা চিত্রকর কালিদাস কর্মকার মাত্র দশ মিনিটে পেস্টাল রঙের বাহারে দুটি চিত্রকর্ম সৃষ্টি করলেন। দুটি চিত্রকর্মে দুইরূপে মানুষের মুখোচ্ছবি।

 

ব্র“নাইয়ের ৫৯ বছর বয়সী শিল্পী শফরী আবদুল গাফর যত্ন নিয়ে আঁকলেন এক রুপালি নৌকা। বললেন, এই নদী ও নৌকা চলাচল দেখে আমি অভিভূত। দুপুর ১২টায় শুরু হয় সংস্কৃতিক পরিবেশনা। শুরুতেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা ‘ও পৃথিবী এবার এসে...’ গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন। বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দীন, শিল্পী গোলাপী, শিল্পী বাবলী দেওয়ান ও কাজল দেওয়ান। শিল্পীরা ‘তুই যদি হইতি গলার মালা’, ‘মরার কোকিল’সহ লালন ও হাছন রাজার গান পরিবেশন করেন। বিদেশি ভাষায় গান ও নৃত্য পরিবেশন করেন ঢাকা সাংস্কৃতিক দলের শিল্পীরা। নৃত্য পরিচালনা করেন সৈয়দা শায়লা আহমেদ লীমা। সংস্কৃতিক আয়োজনটি উপস্থাপনা করেন ইমতিয়াজ আহমেদ সিদ্দিকী।

 

তেতসুইয়া নোদা ছবি না আঁকলেও দেখিয়েছেন জাদু। যোগেন চৌধুরী মেতে ছিলেন আড্ডায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সদরঘাট টার্মিনালে ফেরার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ নৌবিহার।

 

প্রসঙ্গত, আজ সকালে শিল্পীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, লালবাগ কেল্লা ও বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। বেলা ২টায় একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা ভবনের সচেতনতা বৃদ্ধিতে লাইভ পেইন্টিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে।

 

লাইভ পেইন্টিংয়ে অংশ নেবেন রিইউনিয়ন আইয়ারল্যান্ডের শিল্পী চার্লি লেসগুয়েনিন ও মাইকেল বয়ার, মরিসাচের শিল্পী সাঈদ আনিফ, নিশাত পুর্ভো, দেব চেরামুন ও আসলাম মহাগ্রো।

 

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে মাসব্যাপী ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী চলছে।

 

 

সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর