আনোয়ার হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের ছবি
আনোয়ার হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর তোলা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো যেভাবে প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে, তাতে যেন সবাই আবার নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এই শিল্পীর মহিমা।
পৃথিবীর কোনো জাতিতেই খুব বেশি আলোকচিত্রী খুঁজে পাওয়া যায় না, যাঁরা নিজের তাঁদের দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের আলোকচিত্র গ্রহণের জন্য নিজেদের ক্যামেরা ফোকাস করেছেন; অল্পসংখ্যক মানুষই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেবল এই কাজ করেছেন, আনোয়ার হোসেন তাঁদের অন্যতম।
আমাদের লেখার বিষয় যেহেতু আনোয়ার হোসেন মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র, ফলে তাঁর ছবিকে ফোকাস করতে করতেই এগিয়ে যাব আমরা। এর মধ্যে প্রাসঙ্গিকভাবে অবশ্য অন্য আলোকচিত্রীরাও আসতে পারেন।
নিজের তোলা মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রের অ্যালবাম হাতে আনোয়ার হোসেন। ১৯৭১-এর এই ছবি দুটির মধ্যে ডানেরটি দোহার থেকে এবং বাঁয়েরটি বুড়িগঙ্গা থেকে তোলা।
১৯৭১-এর ৯ মাস জীবন–মৃত্যুর প্রান্তরে দাঁড়িয়ে ওয়ান টুয়েন্টি রলিকর্ড ক্যামেরার মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটির একটি মালা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন আনোয়ার। বলা যায়, যেসব বাঙালি আলোকচিত্রী মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে নাইবউদ্দীন ও আনোয়ারই কেবল ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে যুদ্ধাবস্থাকে ধারণ করে তাতে যোগ করেছেন শিল্পকলার সুষমা।
নাইবউদ্দীন ছিলেন গ্রামবাংলার নদী ও মানুষের আলোকচিত্রণের একমাত্র গৌরবময় কারিগর। আর প্রথম যৌবনে আনোয়ার যখন হাতে নিয়েছিলেন ক্যামেরা, সে সময় বৈচিত্র্যভরা পূর্ব বাংলার গ্রামীণ শ্যামলীমাকেই আলোকচিত্রে ধারণ করতে শুরু করলেন আনন্দ চিত্তে। এ ক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসূরি নাইবউদ্দীন আহমেদ, নওয়াজেশ আহমেদ বা আমানুল হক। তবে মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে বদলে দিল। তখন তাঁর নিজস্ব ক্যামেরাও ছিল না। ধার করা ক্যামেরা দিয়ে প্রথমে তুলেছিলেন যুদ্ধের উত্তাপমাখা অনুপম ছবিগুলো। আর মুক্তিযুদ্ধের ছবি তোলার মধ্য দিয়েই প্রকৃতিনির্ভর আলোকচিত্র থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। প্রবেশ করলেন তাঁর স্বকৃত শিল্পজগতে, যেখানে সবকিছু আনোয়ারময়। ল্যান্ডস্কেপের চেনা জগৎ থেকে তিনি প্রবেশ করলেন সিটিস্কেপে। এই প্রথম বিচ্ছিন্ন হলেন পূর্বসূরিদের কাজের সীমানা থেকে। নিজেকে তৈরি করলেন দুর্দান্ত প্রতিভাবান আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে।
সেই অস্থির প্রহরে প্রতিভা, অভিজ্ঞতা ও নিজস্ব নান্দনিকতার ওপর ভর করে সুচিন্তিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের যে অজস্র ছবি তিনি তুলেছিলেন, সেগুলো এখন কোথায় কীভাবে আছে কে জানে!
যুদ্ধদিনে তোলা তাঁর ছবি আমি প্রথম দেখি ১৯৭৩ সালে। ওই বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রথম মহাসম্মেলন উপলক্ষে বিভিন্নজনের তোলা মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। প্রদর্শনীটি হয়েছিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেই সময় তাৎক্ষণিকভাবে কারও কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ভালো ছবি সংগ্রহ করা যায়নি। কেবল ব্যতিক্রম ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তাঁর সঙ্গে অবশ্য আগে থেকেই সরাসরি যোগাযোগ ছিল আমার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম হলে তাঁর রুমে দেখা করে প্রদর্শনীর জন্য ছবি চাইলাম ওঁর কাছে। তাঁকে প্রদর্শনীর আয়োজনের কথা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করবেন—বলার পরমুহূর্তেই খাটের নিচে এবং আলমারি থেকে তিনি বের করলেন বেশ বড় সাইজের সাদা-কালো ৩০টি ছবি।
তত দিনে দেশে ও বিদেশের বহু পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শতাধিক ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যা আমিও দেখেছি। কিন্তু আনোয়ার হোসেন সেদিন সেই একই ইতিহাসের যেসব ছবি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা ছিল আমাদের অন্য আলোকচিত্রীদের ধারণ করা ছবির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা—কম্পোজিশন, ডাইমেনশন সব দিক দিয়েই। অন্যদের ছবি দেখে মনে হতো, এগুলো একজন সংবাদচিত্রীর হাতের কাজ। আর আনোয়ারের ছবিতে যে চিহ্নগুলো পেলাম, শিল্পের উত্তাপ সেখানে আলোড়ন তুলছে ক্ষণে ক্ষণে। কিছু ছবির ফোরগ্রাউন্ড সামান্য ঝাপসা করা। ব্যাকগ্রাউন্ড ঝাপসা করা সেই সময়ে বেশ জটিল ছিল, লেন্স ও ক্যামেরার সীমাবদ্ধতার কারণে।
২৫ মার্চ কালরাতের নারকীয় ঘটনার বেশ কিছু আলোকচিত্র তুলেছিলেন আনোয়ার, যা দেখে রীতিমতো কেঁপে উঠতে হয়েছিল! ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের কয়েকজন বাঙালি জওয়ান, যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল সেই রাতে, ওই ভয়াবহতার ছবি হাতে নিলে হাত তো কাঁপবেই। শ্বাসরুদ্ধকর এক ক্ষণে ক্যামেরার অ্যাপারচার ও স্পিড নিয়ন্ত্রণ করে মেঝেতে ঘুমন্ত ইপিআর বাহিনীর গুলি খাওয়া নিহত সদস্যদের এমনভাবে তিনি ফোকাস করেছিলেন যে গোটা ছবিই তৈরি করেছিল শ্বাসরুদ্ধ এক মায়াজাল।
আবার কুকুর টেনে নিয়ে যাচ্ছে লাশ—এ ছবিতে কুকুরের চোখের যে উন্মাদনা, পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তা যেন একাকার হয়ে যায়। এসব ছবি তোলার জন্য সঙ্গোপনে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ঢুকতে হয়েছিল আনোয়ারকে।
এ ধরনের পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘ডিসাইসিভ মোমেন্ট’, যেখানে ক্যামেরার সামনে যা আসে তাৎক্ষণিকভাবে সবই চলে আসে ছবিতে। এই ‘ডিসাইসিভ মোমেন্ট’–এ ক্যামেরার শাটার বা অ্যাপারচার নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় দুরূহ। কিন্তু আনোয়ার বেশ দক্ষতার সঙ্গেই সেই কাজটি করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। ২৫ মার্চের আরও অনেক ছবি তুলেছিলেন তিনি। মনে আছে, শাহবাগের মোড়ে এখন যেখানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, তার সামনে রাস্তায় গাড়ির ভেতর স্টিয়ারিং ধরে আছেন গুলি খাওয়া একজন, গুলিতে ক্ষতবিক্ষত মুখ। কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে থেকে দৃশ্যটি দেখেছিলেন আনোয়ার, একটি ছবিতে এভাবেই তিনি ধরে রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ চিত্র। মৃত্যুর ছবি অনেক দেখেছি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব মৃতের ছবি তুলেছিলেন আনোয়ার, তারা যেন এক একটি ধ্রুপদি চরিত্র।
তাঁর ক্যামেরায় ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের বিজয়ের যে দৃশ্য দেখেছে বাংলাদেশ, তা তো ‘আইকনিক’ হয়ে গেছে।
বিজয়ের পরপর ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপারে মুক্তিবাহিনীর দুই সদস্য লুঙ্গি–গেঞ্জি পরা অবস্থায় অস্ত্রসহ খালের পারে বসে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, আনোয়ার তাঁদের অনন্য মুহূর্তটি ঘাসফুলসমেত ধরে রাখলেন চিরকালের জন্য। এখানেও তিনি স্রষ্টা ও শিল্পী এবং এক মহান মুক্তিযোদ্ধা।
এর পরও জীবন আর শিল্পকে তিনি টেনে নিয়ে গেছেন বহুকাল। অবিরাম কাজ করে গেছেন আলোকচিত্রে, স্থাপত্যে কাজ করেছেন লুই কানের সঙ্গে, ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করে চিত্রগ্রাহকের কাজে তিনি যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, এ জন্য বাংলাদেশ অনেককাল মনে রাখবে তাঁকে। বাংলাদেশের আধুনিক আলোকচিত্র আন্দোলনের মহানায়ক আনোয়ার হোসেন। তাঁর মতো আন্তর্জাতিকমানের মহাতারকা খুব বেশি নেই আমাদের। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি ছিলেন উপেক্ষিত। তাঁর কাজের ষোলোআনা স্বীকৃতি দিতে পারেনি বাংলাদেশের সমাজ; রাষ্ট্র তার এই কৃতী সন্তানকে জানাতে পারেনি যথার্থ সম্মান ও মর্যাদা।
সূত্রঃ প্রথম আলো
মন্তব্য (0)
ফেসবুক মন্তব্য (0)