শহরে চড়ে বেড়ানো চিত্রকলা

শহরে চড়ে বেড়ানো চিত্রকলা

ঢাকা শহর পুরোটাই তাঁর গ্যালারি। তিনি ছবি এঁকে দিলে সেটি ঘুরে বেড়াত পুরো শহরে। রিকশার পেছনে তিনি আঁকতেন বাঘ, সিংহ, শিয়াল, ময়ূরসহ কত কিছুর ছবি। ছবিগুলোর রং কটকটে। বিষয়বস্তু অসম্ভব-অদ্ভুত। হয়তো দেখা যেত নায়িকাকে মানুষের মতো করে জড়িয়ে ধরে হাসছে একটা বাঘ! একই অঙ্কনশৈলীতে আঁকা হতো সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের মুখ। সিনেমা হলের ওপরে টাঙানো ট্রেলারে যেমনটা দেখা যেত নব্বইয়ের দশকে, ঠিক সে রকম। এ চিত্রকলার সহজ নাম ‘রিকশা পেইন্ট’। লিটন সাহার চিত্রকলার নাম ‘রিকশা পেইন্ট’।

 

গত ২৭ মে বনানীর যাত্রাবিরতিতে শুরু হয়েছে লিটন সাহার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী ‘অবাক’। শনিবার শেষ হচ্ছে সেই প্রদর্শনী। প্রথম একক প্রদর্শনী হচ্ছে, ব্যাপারটি কেমন লাগছে তাঁর কাছে? জানতে চাইলে সংক্ষেপে বলেন, ‘ভালো’। বিস্তারিত বলেন নিজের জার্নির কথা। তাঁর শিল্পযাত্রা দীর্ঘ বা বিচিত্র না হোক, হোক সাধারণ, তবে বর্ণিল।

 

লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগ ছিল না লিটন সাহার। ভিডিও গেম খেলার প্রবল নেশা ছিল। বাবা সুকুমার সাহা ছিলেন ‘দৈনিক বাংলা’র সাংবাদিক। ছেলেকে পেয়েছিল রঙের নেশায়। জজকোর্টের পেছনে ছিল তাঁর দোকান। রাজার দেউড়িতে ভাইয়ের সঙ্গে আঁকতেন তিনি। শুরুতে সিনেমার ট্রেলার, নায়ক-নায়িকা-ভিলেনের মুখ, এখন যেগুলো ডিজিটাল প্যানায় ছাপা হয়। সিনেমা চলাকালীন প্রেক্ষাগৃহের প্রবেশমুখের ওপরে ঝোলানো থাকে।

 

লিটন সাহার একটি চিত্রকর্ম

 

লিটন সাহার একটি চিত্রকর্মবয়স বারো কি তেরো। বেড়ে উঠছিলেন বড় খালার কাছে। সে সময় শুরু হয় লিটনের রিকশায় আঁকার কাজ। গাইতে গাইতে মানুষ যেভাবে গায়েন হয়ে যায়, ঠিক তেমনি আঁকতে আঁকতে দক্ষ আঁকিয়ে হয়ে গেলেন লিটন। এমনও দিন গেছে, রিকশার শ খানেক প্লেট আঁকতে হয়েছে তাঁকে। সামান্য টাকা আসত, তবে বিপুল আনন্দ পেতেন। পথে রিকশা দেখলেই চোখ চলে যেত, নিজের আঁকা চিনতে পারলে ভীষণ আনন্দ হতো তাঁর। পুরান ঢাকা, সূত্রাপুর, সদরঘাট ছিল তাঁর কাজের জায়গা। সেখান থেকে শহরে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ত তাঁর আঁকা রিকশাগুলো।

 

লিটনের ডাক আসতে থাকল অন্য জায়গা থেকে। নিজের ভেতরে তাড়া অনুভব করতে শুরু করলেন তিনি। বিজ্ঞাপনের দেয়ালচিত্র, বিলবোর্ড, উঁচু দালানের দেয়ালজুড়ে কোমল পানীয়র ঘর্মাক্ত বোতলের ছবি এঁকেছেন তিনি। কোমরে দড়ি বেঁধে শূন্যে ঝুলে সেসব আঁকার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে লিটনকে।

 

লিটন সাহার একটি চিত্রকর্ম

 

লিটন সাহার একটি চিত্রকর্ম এখন আর সেই দিন নেই তাঁর। এখন অনেক আরামে কাজ করেন। পুরোনো দিনের কথা ভাগাভাগি করতে গিয়ে বলেন, ‘শিল্পী অর্ণবের মা রানু আন্টি আমাকে নিয়ে যান আনুশেহ আপুর কাছে। আজ থেকে ১৮ কি ১৯ বছর আগের কথা। আপু আমাকে নানা রকম কাজ দিতে থাকেন। বুদ্ধি-পরামর্শ আর নানা রকম সহযোগিতা দিতে থাকেন। একসময় ফ্যাশন হাউস “যাত্রা” শুরু করেন তিনি। যাত্রার ডিজাইনারের দায়িত্ব নিই আমি। এই যে প্রথম একটা প্রদর্শনী হলো, সবাই খুব ভালো-ভালো কথা বললেন, কী যে ভালো লাগছিল, বলে বোঝাতে পারব না। সবাই বলছিলেন, আরও আগে যদি এমন করে কাজ করতে পারতাম, আরও সুনাম হতো আমার।’

এখন লোকজ মোটিফ নিয়ে কাজ করেন লিটন সাহা। প্রদর্শনীতে রয়েছে সে রকমই কিছু ছবি, যেগুলো ৬ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাঁর প্রদর্শনী উপলক্ষে যাত্রা আয়োজন করেছিল ‘অবাক আঁকিয়ে আড্ডা’। ছেলে-বুড়ো যে কেউ সেই আড্ডায় অংশ নিতে পারে। আঁকার কাগজ ও রং প্রস্তুত থাকবে। থাকবেন লিটন সাহাসহ আরও বেশ কয়েক জন শিল্পী। দর্শনার্থীরা যে যা খুশি আঁকতে পারবেন সেখানে। শিল্পীরা সাহায্য করবেন।

আজ শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে আবারও বসবে সেই আড্ডা। ছবি দেখা ও আড্ডার মধ্য দিয়ে একটি বর্ণিল শুক্রবার কাটানোর আহ্বান জানিয়েছেন শিল্পী। ছবিগুলো দেখে আসা যাবে শনিবার পর্যন্ত বেলা ১টা থেকে রাত ১০টা।

 

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো