বাঙালি নারীদের ফটোগ্রাফি চর্চা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে
আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই, উনিশ শতকেই বাঙালিদের মধ্যে ছবি তোলার চল শুরু হয়েছিল। ইংরেজ আমলেই বাঙালি মহিলারা ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন।
১৮৫৮ সালে ফটোগ্রফি সোসাইটি অব বেঙ্গলে ৮৮ জনের নাম তালিকাভুক্ত ছিল ফটোগ্রাফার হিসেবে, যার মধ্যে ৪ জন মহিলা ফটোগ্রাফার ছিলেন। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন মিসেস টি থমসন, মিসেস ই মেয়ার এবং মিসেস সি বি ইয়ং।
সেই সময়টায় অভিজাত পরিবারের নারীরা পালকিতে চড়ে স্টুডিওতে ফটো তুলতে আসতেন। কিন্তু পুরুষ ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তোলাতে আপত্তি থাকার কারনে, মহিলা ফটোগ্রাফার দিয়েই মহিলাদের ফটো তোলার ব্যবস্থা করা হতো।
ভারতীয় অভিজাত পরিবারের নারীরা যেন নিঃসংকোচে নিজেদের ছবি তোলাতে পারেন, সে ভাবনা থেকে মিসেস ই মেয়ার, ৭ নং ওল্ড কোর্ট স্ট্রিট হাউসে একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। সোসাইটির জার্নাল অনুযায়ী, ১৮৭৭ সালে মিসেস ডি গ্যারিক ওয়াটার লু স্ট্রিটে জেনানা স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও কিছুদিন পরেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
১৮৯০ সালের মে মাসের ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার জার্নাল থেকে জানা যায়, ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য নিজে ছবি বিশারদ ছিলেন। তিনি স্ত্রীকেও ফটোগ্রাফিতে উৎসাহ যোগাতেন। তার তৃতীয় স্ত্রী, মহারানি মনমোহিনী সর্বপ্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি ফটোগ্রাফি শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। মনমোহিনী দেবী ফটো তোলার পাশাপাশি, নিজেই ডেভেলপ করতেন।
এছাড়া উনিশ শতকে ঠাকুরবাড়ির মহিলারাও ফটোগ্রাফি চর্চা করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী তার মধ্যে অন্যতম।
সেকালের বিখ্যাত ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রলাল মৈত্রের দুই কন্যা মীরা চৌধুরী এবং ইন্দিরা দেবীও ফটো তুলতেন। মীরা দেবীর তোলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতে তার অটোগ্রাফও আছে।
বাঙালি মহিলাদের মধ্যে সরোজিনী ঘোষ, ৩২ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে প্রথম ‘দ্য মহিলা আর্ট স্টুডিও অ্যান্ড ফটোগ্রাফিক স্টোর’ নামে তার নিজের স্টুডিও খুলেছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকায় তার স্টুডিওর বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল। ১৮৯৯ সালের ১৬ই ফ্রেব্রুয়ারী, অমৃতবাজার পত্রিকার এক আর্টিকেলে তার সম্পর্কে লেখাও হয়েছিল।
১৮৯২ সালে লালা দীনদয়াল, হায়দ্রাবাদে শুধু দেশীয় মহিলাদের ফটো তোলার জন্যে জেনানা স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও এই স্টুডিওতে মিসেস কেনি লেভিক তার সহকারীদের নিয়ে অভিজাত মহিলাদের ফটো তুলতেন।
এছাড়াও ফটোগ্রাফির ইতিহাসে উল্লেখ্যযোগ্য নাম হল, অন্নপূর্না দত্ত। ১৯৩০ সালে থেকে ১০ বছর পেশাদার ফটোগ্রাফির কাজ করেছিলেন তিনি।
(অন্নপূর্না দত্তের তোলা নিজের আত্নপ্রতিকৃতি, ১৯২০)
(অন্নপূর্ণা দত্তের তোলা ছবি, ১৯২০)
এরপর যার নাম আসে তিনি অন্নপূর্ণা গোস্বামী। তিনি পেশাদার ফটোগ্রাফার না হলেও, ফটোগ্রাফির বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, রেললাইনের পাশে কুঁড়ে ঘরে থাকা মানুষের ছবি, দেশভাগের পরে কলকাতায় আসা শরণার্থীদের ছবি।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সালে ফটোগ্রাফার হিসেবে নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, দেবলীনা এবং মনবীণা সেন রায় এর। তাদের প্রথম ফটোগ্রাফ প্রকাশিত হয় ‘সচিত্র ভারত’ জার্নালে। ইলাস্ট্রেটেড ডেইলিতে নিয়মিত তাদের তোলা ছবি প্রকাশ হতো।
( দেবলীনা মজুমদারের তোলা ছবি, ১৯৭৫)
তাই বলা যায়, উপমহাদেশের ফটোগ্রাফি চর্চার ইতিহাসে পুরুষদের নাম যতটা জানা যায়, নারীদের কথা সেভাবে উল্লেখ করা হয় না, কিন্তু বাঙালির ফটোগ্রাফির ইতিহাসে নারীদের ভূমিকাও কম নয়।
সূত্র এবং ছবি-কোড.লিব.ইউমেক.এডু
মন্তব্য (0)
ফেসবুক মন্তব্য (0)