পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবি, কিন্তু কেন এই ছবি এত দামী ?

পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবি, কিন্তু কেন এই ছবি এত দামী  ?

পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবিটি, কেন এত দামী সেটি নিয়ে তার মতামত লিখেছেন, ফটোগ্রাফার জশুয়া ডানলপ।

 

পত্রিকায় যখন পড়লাম পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবি হিসেবে একটি ছবি নিলামে বিক্রি হয়েছে ৪৩ লাখ ডলারে।  এই ছবিটির ব্যপারে আমার জানার আগ্রহ হলো , কি কারনে এই ছবিটি এত দামে বিক্রি হলো? কি এমন আছে এই ছবিতে ?

 

ছবিটির নাম Rhine II, ফটোগ্রাফার আন্দ্রেস গার্স্কি ১৯৯৯ সালে তুলেছেন। ছবিটি দেখার পর আমার প্রথম অনুভূতি ছিল, ‘ছবিটি আমার একেবারেই ভালো লাগছে না’।  তারপর আমি ছবিটির দিকে আবার ভালো মতো লক্ষ্য করলাম এবং এবার বাড়তি কিছু বিষয় আমার চোখে পড়লো।

 

একটি ছবির দামের সাথে, ছবির পাশাপাশি অন্যান্য কিছু বিষয়ও জড়িত থাকে। আর্টিষ্ট এর খ্যাতি, তার পুরোনো কাজের খ্যাতি ইত্যাদি। আজ যদি আমি ‘পিকাসো’র একটি পেইন্টিং কে ‘পিকাসো’র মতো করেও আঁকি, সেটা কখনোই ‘পিকাসো’র নিজের আঁকা ছবির মতো দামী হবে না।  একটি ছবির দাম এর সৌন্দর্যের পাশাপাশি আর্টিস্টের উপরও নির্ভর করে। আন্দ্রেস গার্স্কি বর্তমানে পৃথিবীর সেরা ফটোগ্রাফারদের মধ্যে একজন। তার খ্যাতি এবং ছবির দুস্প্রাপ্যতাও এই ছবির দামী হওয়ার একটি বিষয়। কারন এই ছবিটি প্রথম ৬টি প্রিন্টের প্রথম প্রিন্ট এবং সবচেয়ে বড়, এই দুটি বিষয়ের জন্যেও হয়তো কেউ এত দাম দিয়ে এই ছবিটি কিনেছেন। কিন্তু আমার জানার ইচ্ছা ছিল এই ছবিটির মধ্যে আর্টিষ্ট এর খ্যাতি ছাড়া বাড়তি আর কি বিষয় আছে?

 

আসলেই কি এই ছবিটি এত মূল্য পাওয়ার মতো ?

কোনো ছবি ক্রয়ের জন্য ক্রেতা যে দাম দিতে রাজী থাকেন, সেটাই তার মূল্য।  যিনি এই ছবিটি কিনেছেন তার কাছে মনে হয়েছে, এই ছবিটি পেতে তিনি এই পরিমান অর্থ খরচ করতে রাজী আছেন। কিন্তু আপনি এবং আমি হয়তো সেটা মনে করি না।

 

আন্দ্রেস গার্স্কির “৯৯ সেন্ট” ছবি

 

আন্দ্রেস গার্স্কির আগের কিছু ছবি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবির তালিকায় ছিল। তার একটি “৯৯ সেন্ট” এবং এটি ছিল একটি সুপারমার্কেটে তোলা ছবি। তবে সেই ছবিটিতে যথেষ্ট ভিজ্যুয়াল ইলিমেন্ট ছিল, ছবিটি দামী হয়ে উঠার জন্য। 

 

আন্দ্রেস গার্স্কি নিজেকে দামী ছবির ফটোগ্রাফার হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন, কিন্তু আমি ভাবি অনেক মানুষই নিশ্চয়ই এই ছবি দেখে ভাবছে, “আমিও তো এমন ছবি তুলতে পারতাম”, তাহলে এটা এত দামী হওয়ার কি আছে? কিন্তু “আমি তুলতে পারতাম” এবং “আমি তুলেছি” এই দু’য়ের মধ্যে যথেষ্ঠ পার্থক্য রয়েছে। কেউ প্রথমে এভাবে দেখতে পেরেছে। আর তারটা দেখে অন্যজন ভাবে, আমিও তুলতে পারতাম। প্রথমে যে পদক্ষেপ নিবে তার হিসেবটাই ভিন্ন। আন্দ্রেস গার্স্কি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্রথমে এই ছবি তোলার কথা ভেবেছেন এবং পরে যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই ছবিটি তুলেছেন।

 

যদিও ছবিটি ১৯৯৯ সালে তোলা, ডিজিটালাইজড এবং ফটোশপের কাজ করা হয়েছে, আন্দ্রেস গার্স্কি ছবির ইলিমেন্টগুলোর যথার্থ ব্যবহার করেছেন।

 

১. প্রথমে যেটা লক্ষ্য করলাম, আন্দ্রেস গার্স্কি ছবির দিগন্ত রেখাকে অর্ধেক রেখে কেটে দিয়েছেন, অথচ আমি হলে তা করতাম না।

 

২. ছবিতে আকাশকে তত আকর্ষনীয় মনে হয় না, আমি হয়তো আকাশ আরো কম ধরতাম এই ছবিতে, কিন্তু তিনি যতটুকু ধরেছেন, সেটাই আপনার দৃষ্টিকে দীর্ঘসময় ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করবে।

 

৩. ছবির রেখাগুলো নিখুঁত সরলরেখা। প্রকৃতিতে এমনটি সহজে হয় না, সবকিছু এত স্ট্রেইট লাইনে থাকে না। আন্দ্রেস গার্স্কি হয়তো এখানে ফটোশপের মাধ্যমে কিছুটা কাজ করেছেন।

 

৪. ছবিতে কোন শক্তিশালী ভিজ্যুয়াল ইলিমেন্ট নেই, কিন্তু অনেকগুলো অনুভূমিক রেখা থাকার কারনে, ছবিটিকে বেশ ব্যালান্সড মনে হচ্ছে। রেখাগুলো পৃথিবীর শক্তি এবং অনুভূতিকে  আরো বেশী দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছে।

 

৫. ছবিটি দেখলে, আমার কাছে খুব গোছানো মনে হয়। কারন ছবির মধ্যে থাকা রেখাগুলোর দিকে তাকালে আপনার মনে হতে থাকবে, কখনোই যেন শেষ হওয়ার নয়।

 

৬. নদী কখনোই সোজা লাইনে চলে না, এমনকি এত নিখুঁত স্ট্রেইট লাইনে দেখা যায় না। ফটোগ্রাফার এখানে তার দৃষ্টিভঙ্গীতে, তার অনুভূতিতে নদীকে যা দেখতে চেয়েছেন, সেটাই তুলে ধরেছেন। আমার কাছে, এখানে নদী একজন আধুনিক মানুষের চোখে সরল রেখায় চলেছে এবং জীবনের অনুভূতি দিয়েছে। নদীর গতি এবং প্রকৃতি একজন মানুষের তৈরি করা পথে চলেছে এখানে।

 

৭. পুরো ছবিতে দুটি প্রধান কালার হলো ধূসর এবং সবুজ। এ দুটি রং আপনাকে চিরকালীন সাদা-কালো ছবির কথা মনে করিয়ে দেয় যখন শুধু দুটি কালারেই ছবি তোলা হতো।

 

৮. গার্স্কি এই ছবিতে কম্পোজিশনের কিছু “রুলসের” বাইরে গেছেন। আমি এমনটা করতাম না কারন এটা আমার কাছে কোন ভাবেই ভালো ফটোগ্রাফির অংশ মনে হয় না। এখানেই গার্স্কি দেখাতে পেরেছেন “রুলস আসলে তৈরিই হয়েছে ভাঙ্গার জন্য ”।

 

৯. এই ছবির দিকে তাকালে আপনি একই সাথে অনেক ধরনের অনুভূতি পাবেন, অনেক বেশী বিস্তৃত হওয়ার অনুভূতি, অথবা শূণ্যতার অনুভুতি, এই ছবিটি আপনাকে কিছু একটা অনুভূতি দিবে।

 

১০. গার্স্কির সার্থকতা এখানেই, তিনি একঘেয়ে এবং আকর্ষনহীন একটি ছবি দিয়ে, যেভাবে আমরা ভাবি না সেভাবে অন্যকে ভাববার সুযোগ দিয়েছেন, অনুভব করার সুযোগ দিয়েছেন।

 

ফটোগ্রাফিতে কম্পোজিশন শেখার মাধ্যমেই আপনি ফটোগ্রাফি শেখার ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারবেন। আপনি জানতে পারবেন, ‍রুলসের অপব্যবহার করেও সুন্দর ছবির কাজ তৈরি করা যায়। গার্স্কির লেভেলে ফটোগ্রাফিতে, ছবির কম্পোজিশনের চেয়ে, ছবিকে অনুভব করতে পারাই হলো ছবির সার্থকতা। তাই যার কাছে এই ছবির অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা আছে, এবং মূল্য পরিশোধের সামর্থ আছে, সে তো ছবিটির জন্যে ৩৬ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা খরচ করতেই পারেন। এতে অবাক হবার কি আছে???

 

 

 

সুত্রঃ এক্সপার্ট ফটোগ্রাফি