পনিরের হাতে পুলিৎজার
তিনি কেন কাঁধে ক্যামেরা তুলে নিলেন, কেনই-বা পেশা হিসেবে বেছে নিলেন আলোকচিত্র—সে প্রশ্নই করেছিলাম আলাপের এক ফাঁকে। উত্তরে পনির হোসেন যা বললেন, তা একটু ভড়কে দেওয়ার মতোই! তিনি বললেন, ‘ভাবতাম, আলোকচিত্রীদের জীবনটা কত সুন্দর! কোনো কাজকর্ম নেই। সারা দিন শুধু ঘুরে বেড়ানো আর ছবি তোলা। আরামপ্রিয় মানুষ বলেই হয়তো, আলোকচিত্রী হওয়ার ইচ্ছা সেখান থেকেই।’
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের আলোকচিত্রী পনির হোসেন সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানার পর অবশ্য মনে হলো না তিনি আরামপ্রিয় মানুষ। বরং তাঁর তোলা ছবিতে গভীরভাবে নজর দিলে দেখা যায়, ক্যামেরার পেছনের পরিশ্রমী আর আন্তরিক এক আলোকচিত্রীকে। যেমন পনির হোসেনের সে ছবিটার কথাই বলা যাক। তাঁর ছবিটি কে তুলেছিলেন, জানা না গেলেও সেখানে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নৌকাবোঝাই ভীতসন্ত্রস্ত একদল মানুষ কূলের কাছে ভাসছেন। তাঁদের ছবি তুলতে বুকপানিতে নেমে ক্যামেরা চালাচ্ছেন পনির হোসেন।
কাজের প্রতি এই আন্তরিকতার পুরস্কারও পেয়েছেন সম্প্রতি। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ১৬টি ছবির জন্য ‘ফিচার ফটোগ্রাফি’ বিভাগে সম্মানজনক পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে রয়টার্স। এর মধ্যে তিনটি ছবি রয়েছে পনির হোসেনের তোলা। আলোকচিত্রে নোবেলখ্যাত পুলিৎজার জেতার পর কী মনে হয়েছিল পনির হোসেনের? তাঁর একবাক্যে উত্তর, ‘সে রাতে আমার আর ঘুম হয়নি।’
ছবির জন্য পনির হোসাইন
রয়টার্স ডাকল পনিরকে
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপণনে পড়াশোনার সময় ফটোগ্রাফি ক্লাবের এক কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন পনির হোসেন। মূলত সেখানেই ছবি তোলায় হাতেখড়ি। ২০০৯ সালের ঘটনা সেটা। পরের বছর নিজের ক্যামেরা হাতে পান। এরপর টুকটাক ছবি তোলা শুরু। কিছুদিন পর শখের কাজই হয়ে দাঁড়ায় পেশা। মার্কিন সংবাদ সংস্থা জুমা প্রেসে প্রদায়ক আলোকচিত্রী হিসেবে ছবি জমা দেওয়া শুরু করেন। প্রায়ই তাঁর ছবি ছাপা হতে থাকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সে ওয়েব ঠিকানাগুলো ভাগাভাগি করেন ফেসবুকে। ফেসবুকের সেসব কাজই দেখেন রয়টার্সের এশিয়া ফটো এডিটর-ইন-চার্জ আহমাদ মাসুদ, পনির হোসেনের কাছে কাজের পোর্টফলিও চান। কাজ দেখেই রয়টার্স তাঁকে নিয়োগ দেয় ২০১৬ সালের ১ জুলাই।
নিয়োগ পাওয়ার পরই ঘটল রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা। ছবি তোলার দায়িত্ব পড়ল পনির হোসেনের ওপর। শুরু হলো তাঁর রয়টার্স-জীবন। এমন সংকট মুহূর্তে কীভাবে ছবি তুলতে হয়, সেই ঘটনার পর যুক্তরাজ্যে গিয়ে নিলেন প্রশিক্ষণ।
রোহিঙ্গা শিবিরের দিনরাত
রয়টার্সে দায়িত্ব পাওয়ার পরই যেন একের পর এক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছিল। স্মরণকালের সবচেয়ে মানবিক বিপর্যয় ঘটল মিয়ানমারে, লাখো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ পাড়ি জমাল বাংলাদেশের কক্সবাজারে। চলে গেলেন পনির হোসেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ছবি তোলার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ংকর। তিনি বলছিলেন, ‘সীমান্তের ওপারে ছিল মৃত্যুভয়। এপারে আশার আলো। সে আলোর ঝোঁকেই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। সবাই ক্ষুধার্ত-ভয়ার্ত-ক্লান্ত। হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কেউ কাদায় মাখামাখি হয়েছে। যারা নৌপথে পাড়ি জমিয়েছে, তাদের চোখের সঙ্গে সমুদ্রের নোনাজল মিলেমিশে একাকার হয়েছে। তাদের অনেকেই পুরো পথ পাড়ি দিতে পারেনি, মাঝপথেই মৃত্যু হয়েছে।’
মায়ের বুকে মৃত্যুপথযাত্রী এমনই এক নবজাতকের ছবি তোলেন পনির হোসেন। ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপে নৌকাডুবিতে অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ হারান, সে নবজাতক শিশুটিও ছিল নিহত ব্যক্তিদের তালিকায়। পুলিৎজারের তালিকায় পনিরের আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এক জায়গায় জমায়েত করে রেখেছিলেন। তবে মাথার ওপর খোলা আকাশ। অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়। এক ছাতার নিচে ঠাঁই নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিন মানুষ। কাদা-পানিতে মাখামাখি হয়ে কোনো রকমে মাথা ঢাকার চেষ্টা। অন্য ছবিটিতে ভেলায় চলে পাড়ি দেওয়া একঝাঁক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে পাড়ি জমানোর চিত্র দেখা যায়।
ওপরের তিনটি ছবির জন্যই যৌথভাবে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন পনির হোসাইন
সুদূরের ভাবনা নেই!
আলোকচিত্রী হিসেবেই কাজ করে যেতে চান পনির হোসেন। ক্যারিয়ারের যেহেতু সবে শুরু, তাই সুদূরের ভাবনাও নেই। বললেন, ‘যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কভার করা মানে সে ঘটনার সাক্ষী হওয়া। ছবি তুলে হয়তো সে ঘটনা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা নেই; তবে সারা পৃথিবীর মানুষকে জানানো তো যায়।’
সূত্রঃ মেহেদী হাসান, দৈনিক প্রথম আলো
মন্তব্য (0)
ফেসবুক মন্তব্য (0)