শোয়েবের ছবি সেরা হলো লন্ডনে
ফুড ফর গড’ বা ‘স্রষ্টার জন্য খাবার’ কথাটার মধ্যেই একধরনের ভক্তি বা আবেগের ছোঁয়া। এক ব্রাহ্মণ বাবুর্চি নিমগ্নচিত্তে বড় হাঁড়িতে খাবার রান্না করে চলেছেন। পাশের ঘরে সারি সারি বসা নারী-পুরুষ। মোমবাতি জ্বেলে প্রার্থনায় মগ্ন। আলোকচিত্রী শোয়েব ফারুকী এমন একটি মুহূর্ত তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন। নাম দিয়েছেন তিনি ‘ফুড ফর গড’। আর সে ছবিই জিতে নিল বিশ্বের একটি মর্যাদাপূর্ণ আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার বর্ষসেরা পুরস্কার।
শোয়েব ফারুকীর ফুড ফর অ্যাকশন শিরোনামের ছবিটিও পুরস্কার জেতে
যুক্তরাজ্যের বাজারে ‘পিংক লেডি’ নামে বেশ সুস্বাদু আপেল পাওয়া যায়। এই পিংক লেডিই ছয় বছর ধরে খাদ্য আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে। ‘পিংক লেডি ফুড ফটোগ্রাফি কম্পিটিশন-২০১৭’-এর জন্য এ বছর বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশ থেকে ৮ হাজার ৪০০ ছবি জমা পড়ে। ২৬টি বিভাগ রয়েছে এই প্রতিযোগিতায়। এগুলোর মধ্যে ‘উৎসবের জন্য খাবার’ (ফুড ফর সেলিব্রেশন) বিভাগে সেরা ছবির পুরস্কার জেতে ফুড ফর গড ছবিটি। আর এই ছবিটিই সব বিভাগ মিলিয়ে এবারের বর্ষসেরা আলোকচিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
গত ২৫ এপ্রিল লন্ডনের দ্য মল গ্যালারিতে এক জমকালো অনুষ্ঠানে শোয়েব ফারুকীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন জুরিবোর্ডের চেয়ারম্যান স্বনামধন্য সাংবাদিক ও খাদ্য সমালোচক জে রেইনার। পুরস্কার হিসেবে শোয়েব পান পাঁচ হাজার পাউন্ডের (পাঁচ লাখ টাকা) চেক। সেটি দেন পিংক লেডির প্রধান অ্যান্ডি ম্যাকডোনাল্ড। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের এই আলোকচিত্রী পাচ্ছেন ছবি বিক্রির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত ওয়েবসাইট ‘জেনফোলিও’-র আজীবন সদস্যপদ। যেটির সদস্য ফি বার্ষিক ৩০ হাজার টাকা। মল গ্যালারিতে ২৫ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত পুরস্কার পাওয়া ছবিগুলোর প্রদর্শনী চলছিল।
শোয়েব ফারুকীর জন্ম ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের পটিয়ায়। পরিবার নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। কাজ করেন ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে। বাবা মিয়া ফারুকী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক।
৩০ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনে বিবিসি বাংলার সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায় দেখা হয় শোয়েব ফারুকীর সঙ্গে। আন্তর্জাতিক পুরস্কার জেতা তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। ২০০৫ সালে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোগ্রাফি’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরস্কার জেতার মধ্য দিয়ে এর শুরু। ‘কুয়েত গ্র্যান্ড’, ‘এমিরেটস ফটো কনটেস্ট’সহ শতাধিক পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
ফুড ফর গড
ফারুকী বললেন, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি উপাসনাকেন্দ্র রাজাপুর লোকনাথ ধাম চিটাগাং। সন্ধ্যার দিকে সেখানে পূজাপর্ব শুরু হয়, চলে দুই ঘণ্টার মতো। পূজারিরা ২৪ ঘণ্টার মতো উপোস থাকেন এবং প্রার্থনা শেষে তাঁরা এখানেই খাবার খান। গত বছরের শেষের দিকে সেখানেই ছবিটি তুলি। প্রার্থনারতদের জন্য খাবার তৈরিতে রাঁধুনির নিমগ্নতা দেখেই ছবির নাম দিই ফুড ফর গড।’
ছবিটি বর্ষসেরা হওয়ার কারণও এটাই। অন্যান্য প্রতিযোগী যেখানে কেবল খাবারের ছবি তুলে পাঠিয়েছেন, সেখানে ফারুকীর ছবি খাবার নিয়ে এক অন্য রকম বার্তা দিচ্ছে। বিচারকদের একজন রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রধান নির্বাহী মিকাইল প্রিচার্ড বলেছেন, অনেকের কাছে খাবার কেবল ক্ষুধা নিবারণের বিষয় নয়, কখনো কখনো এটা বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার অংশ। সচরাচর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া খাবারের ওই বিশেষ দুটি দিক ফারুকীর ছবিতে উঠে আসার কারণেই এটি বর্ষসেরা বিবেচিত হয়েছে।
এ প্রতিযোগিতায় ‘ফুড ইন অ্যাকশন’ নামের অন্য একটি শ্রেণিতে ফারুকীর আরেকটি ছবি দ্বিতীয় পুরস্কার জেতে। সেটি চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট এলাকার একটি লবণ শোধনাগারে তোলা।
যেভাবে শুরু ছবি তোলা
পারিবারিক ছবির অ্যালবাম দেখেই ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় ফারুকীর। বয়স যখন ২০ বছর, তখন থেকেই অন্যের কাছ থেকে ধার করা ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু। তখন মানুষের ছবি তুলতেন। এরপর প্রকৃতির ছবি তোলা শুরু হলো ফারুকীর। বললেন, তখন ঘরে ঘরে ক্যামেরা ছিল না। একজন ছাত্রের পক্ষে তখন ক্যামেরা কেনাটাও সহজ ছিল না। তাই ধার করা ক্যামেরা দিয়েই চলতে থাকল। অবশ্য এ শখ মেটাতে তাঁকে একবার চড়া মূল্যও দিতে হয়েছে। বিদেশফেরত এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ক্যামেরা এনেছিলেন ছবি তুলতে। সেই ক্যামেরা অল্প সময়ের মধ্যে ফেরত দেবে বলে নিয়ে যায় আরেক বন্ধু। কিন্তু ক্যামেরা আর ফেরত আসেনি। শেষ পর্যন্ত মায়ের সোনার চুড়ি বিক্রি করে সাড়ে চার হাজার টাকায় একই মডেলের একটি ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন ফারুকী।
হাতে এল নিজের ক্যামেরা
১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করলেন। পরের বছর যোগ দিলেন একটি ওষুধ কোম্পানিতে। কিন্তু যাঁর মাথায় ছবি তোলার ভূত চেপেছে, তাঁকে দিয়ে কি আর চাকরি হয়? ক্যামেরা কেনার টাকা জমিয়ে চাকরিকে বিদায় দিলেন। আড়াই হাজার টাকায় কিনলেন প্র্যাকটিকা এসএলআর ক্যামেরা। শৌখিন ছবির পাশাপাশি শুরু হলো বিয়ের ছবি তুলে আয় করা।
ছবি বিক্রির চমক
১৯৮৯ সালে হুট করেই দুটি ক্যালেন্ডার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছবি চাইল। মিলল ভালো অর্থ। সাহসও বেশে বেড়ে গেল ফারুকীর। এরপর সোনালী ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে ছবি বিক্রির সুযোগ এল। সেই থেকে প্রতিবছর বাড়তে থাকল ছবি বিক্রি। আর বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা যাচ্ছে ছবি। ফারুকী বলেন,
এখন প্রতিবছর তিন শতাধিক ছবি বিক্রি হয়।
পুরস্কার আর পুরস্কার
নিজের কাজের মান যাচাই করতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকলেন শোয়েব ফারুকী। এক দশক ধরে তিনি প্রতিবছরই একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতছেন। এসব পুরস্কার ছবি তোলার পেশাকে আরও শাণিত করে বলে মন্তব্য তাঁর।
নিজেই এখন প্রশিক্ষক
ছবি তোলার জন্য ফারুকী প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেননি। তবে এখন চট্টগ্রাম শহরের সার্সন রোডের আলোকচিত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্র ফটো আর্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক তিনি। প্রতিবছর ২৫০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থী এখান থেকে প্রশিক্ষণ নেন। ফটো এজেন্সি নামে নিজের একটি ছবি বিক্রির প্রতিষ্ঠানও আছে তাঁর।
সূত্র: https://goo.gl/jsAoew
মন্তব্য (0)
ফেসবুক মন্তব্য (0)